স্টাফ রিপোর্টার:
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার আমচাষিরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। আর কদিন পর শুরু হবে হাঁড়িভাঙা আমের ভরা মৌসুম। তাই এখানকার হাজারো আমচাষিরা এখন ব্যস্ত হাঁড়িভাঙা আম ঘিরে।
মিঠাপুকুরের খোঁড়াগাছ, ময়েনপুর, চেংমারী, বালুয়া মাসুমপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় হাঁড়িভাঙা আমের চাষ হয়েছে প্রচুর। এসব এলাকা যেন এখন হাঁড়িভাঙা আমের রাজ্য। সরেজমিনে দেখা যায়, আমবাগানের মালিক, আমের ফড়িয়া, আমবাগানের পরিচর্যায় নিয়োজিত ব্যক্তি, মৌসুমি আম বিক্রেতা, অনলাইনে আম বিক্রেতা, পরিবহন ব্যবসায়ী, কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসায়ী—সবাই যে যাঁর মতো করে আম কেনাবেচার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
মিঠাপুকুরের খোড়াগাছ ইউনিয়নে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে রাস্তার দুই ধারে সারি সারি হাঁড়িভাঙা আমবাগান। গাছে থোকায় থোকায় আম। বাড়ির ভেতরে, উঠানে, রাস্তায়—সবখানে হাঁড়িভাঙা আমগাছ। অধিকাংশ চাষি অপেক্ষা করছেন আম পরিপক্ব হতে কৃষি বিভাগের বেঁধে দেওয়া সময়ের জন্য। তবে কেউ কেউ আম পাড়া শুরু করেছেন। তাঁরা বলেছেন, অতিরিক্ত গরমে এ বছর নির্ধারিত সময়ের আগে আম পাকা শুরু হয়েছে।
প্রতিবছর আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে হাঁড়িভাঙা বাজারে আসার তারিখ ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন। তবে এ বছর এমন উদ্যোগ এখনো দেখা যায়নি। জেলা ও উপজেলা কৃষি বিভাগ ১৫ জুনের পর ‘পরিপক্ব’ আম বাজারজাত করতে আমবাগানের মালিক ও ব্যবসায়ীদের পরামর্শ দিচ্ছে।
মিঠাপুকুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুহাম্মদ সাইফুল আবেদীন বলেন, আগের বছরগুলোতে ১৫ থেকে ২০ জুনের মধ্যে হাঁড়িভাঙা আম বাজারে আনার তারিখ দেওয়া হয়েছিল। সে হিসেবে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে ১৫ জুনের পরে গাছ থেকে আম সংগ্রহের কথা বলা হচ্ছে।
হাঁড়িভাঙা আমের নাম আগে ছিল মালদিয়া। হাঁড়িভাঙা নামকরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মিঠাপুকুর উপজেলার খোঁড়াগাছের তেকানী গ্রামের নফল উদ্দিন পাইকারের নাম। তিনি ছিলেন এক বৃক্ষপ্রেমিক।
আমজাদ হোসেন বলেন, গাছটিতে একসময় প্রচুর পরিমাণ আম ধরে। খেতে খুবই সুস্বাদু। বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে গেলে লোকজন এই আম সম্পর্কে জানতে চান। তখন তাঁর বাবা মানুষকে বলেন হাঁড়িভাঙা গাছের আম এগুলো। তখন থেকেই গাছটির আম হাঁড়িভাঙা নামে পরিচিতি পায়। শুধু তা–ই নয়, এটি পরিণত হয়েছে রংপুরের ‘ব্র্যান্ডে’। পেয়েছে জিআই পণ্যের স্বীকৃতিও। নফল উদ্দিনের বাড়ির হাঁড়িভাঙা আমের মাতৃগাছটি এখনো বেঁচে আছে।
আমচাষি, ব্যবসায়ী ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গড়ে ৫০ টাকা কেজি ধরলেও হাঁড়িভাঙা আমকে কেন্দ্র করে রংপুরে এ মৌসুমে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার লেনদেন হবে।
মিঠাপুকুরের খোঁড়াগাছ ইউনিয়নের পদাগঞ্জ হাঁড়িভাঙা আমের প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র। দেশের বিভিন্ন এলাকার আম ব্যবসায়ীরা এখানে আসেন মৌসুম শুরুর পাঁচ-সাত দিন আগে। তাঁরা ঘর ভাড়া নিয়ে সেখানে থাকেন। উপজেলার পদাগঞ্জ বাজারে আমের আকার ও মানভেদে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা মন বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানান, হাঁড়িভাঙা আমের মৌসুমে পদাগঞ্জ থেকে পাঁচ-ছয়টি কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সারা দেশে ভোক্তা পর্যায়ে আম পৌঁছে দেয়।
তবে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বাগানমালিকেরা বলছেন, আম বাজারজাতকরণ নিয়ে বেশি সমস্যা হয় পদাগঞ্জ বাজারে। পদাগঞ্জ হাঁড়িভাঙা আমের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র হওয়ায় মিঠাপুকুর, বদরগঞ্জ ছাড়া বিভিন্ন এলাকার ছোট ছোট ব্যবসায়ী আমবাগানের মালিকদের কাছ থেকে আম কিনে পদাগঞ্জে বিক্রি করতে আসেন। কিন্তু হাটে সামান্য বৃষ্টি হলে পানি জমে থাকে। বাজারে শেড নেই। কাদা-পানিতে চলাচল কঠিন হয়ে পড়ে। ট্রাক, পিকআপ চলাচলের রাস্তা সরু, খানাখন্দে ভরা। এতে আম কিনতে এসে পরিবহন নিয়ে ভোগান্তিতে পড়েন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ী বলেন, প্রতিবছর জেলা প্রশাসক ও ইউএনও আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। রাস্তাঘাট ভাঙা থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু সংস্কারের ব্যবস্থা করেন। তবে এ বছর রাস্তা সংস্কারের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।এছাড়াও হাঁড়িভাঙা আম সংরক্ষণের জন্য এ অঞ্চলে একটি বিশেষায়িত হিমাগারের দাবি দীর্ঘদিনের। গত বছরের ২১ জুন মিঠাপুকুরের পদাগঞ্জে এসে ‘জিআই পণ্য হাঁড়িভাঙা আম মেলা ও প্রদর্শনী’র উদ্বোধন করে বিশেষায়িত হিমাগারের ঘোষণা দেন তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ।
তবে হিমাগার স্থাপন নিয়ে মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্বে) মো. মুলতামিস বিল্লাহ ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুহাম্মদ সাইফুল আবেদীন সরকারের কোনো উদ্যোগের কথা জানাতে পারেননি।